বেইলি রোডের ক্যাপিটাল সিরাজ সেন্টারের ৬ তলায় ফুড কর্ণারে পৌঁছে গেছি লিফটের ৫ নাম্বার বাটন চিপে।
ফ্লোরের শেষ প্রান্ত ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত স্বচ্ছ গ্লাসে বাঁধানো। সেখানে লাইন করে সিট বসানো। টেবিলের উপর লেখা “ফর ফোর পারসন্স”।
আমি এখন একা, একটু পরেই ইমন আসবে। মোট দু’জন। তবুও ইচ্ছে হলো ও সিটেই বসতে। ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করলে বলবো আমরা চারজন।
গ্লাস ওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে নিচের ছটফট করা গাড়ি দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। চোখের সামনে পাঁচ তলা ছয় তলা বিল্ডিং। মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলছি। ভালো লাগছে না।
ইমনকে বারবার বলছি ও কে বিয়ে করতে চাই না আমি। ওর প্রতি প্রেম মরে গেছে দশ বছর আগেই। ওর দুর্ব্যবহারে মরে গেছে ওটা। আর বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ও কথা শুনছে না। আমাকে বউ করতে চায়। ওর দ্বিতীয় বউ। পুরো অনিশ্চিত একটা জীবন। আমি একটা কুমারী মেয়ে। কেন আমি দ্বিতীয় বউ হতে যাবো! তাও আবার ইমনের প্রতি আমার কোন মায়া মমতা কিছুই নেই বর্তমানে।
এরপরেও বিদেশ থেকে এসে পড়েছে। বলেছে আমার সাথে কথা আছে, দেখা করতে চায়।
গত এক বছর থেকে প্রিপারেশন নিয়েছি ওকে কত শক্তভাবে না বলা যায়। যদিও প্রতিবার টেক্সটের জবাবে বলে এসেছি আমি চাই না তোমাকে।
আমাদের প্রথম পরিচয় ২০১১ সালে। সাইফুরস কোচিং সেন্টারে। বিসিএস পরীক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়। বিসিএস কি জিনিস আমার জানা ছিলো না তখনো। বান্ধবী নিয়ে গিয়েছিলো। বলেছিলো আমার ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই। আমি ভার্সিটি যেতাম না। কারণ শিক্ষকরা ক্লাস না নিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতেন। কি কাজ ওনারাই ভালো জানেন। ভার্সিটিই যেতাম না, আর বড় ভাইদের কি চিনবো।
তো, ক্লাসে গেলাম। প্রথম ক্লাসেই মুগ্ধ হয়ে পড়েছি ইমনের পান্ডিত্য দেখে। কত কত বইয়ের রেফারেন্স, কত কত কাহিনী হর হর করে বলে যাচ্ছে। আমি তখন ভাবছিলাম সারা ভার্সিটি লাইফ করলাম কি! আমার তো কোন বিষয়ের উপরেই পান্ডিত্য নেই!! এ ছেলের সাথে আগে পরিচয় হলো না কেন? তাহলে অন্তত পড়ালেখার প্রতি আমার আগ্রহ হতো।
আমি সারা বছরেও বই উল্টাতাম না। ওসব ব্রিটিশ, আমেরিকা, আফ্রিকার প্রেম কাহিনী পড়ে আমার কি লাভ! প্রতি পরীক্ষার আগের দিন রাতে শিবলী ভাইকে ফোন করতাম। শিবলী ভাই আমার দু’ ব্যাচ সিনিয়র। ভাইয়াকে ফোন করে বলতাম। চারটা বই থেকে চারটা ব্রড প্রশ্ন আসবে। চার বিশে আশি নাম্বার। এক্সপ্লেনেশন বিশ নাম্বারের ওটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছি। আমি দুটো বইয়ের সামারি পড়েছি আপনি আর দুটো বইয়ের গল্প শোনান। শিবলী ভাই প্রতি বছর আমার এ আবদারের জবাবে প্রথমেই বিরক্ত হয়ে ধমক দিতেন – “আরে! আমি কি পীর ফকির নাকি আমি যা বলবো, তা-ই আসবে।”
আমার কাছে শিবলী ভাই আসলেই দরবেশ টাইপের। উনি যা বলেন তা-ই পরীক্ষায় আসে।
আমি জবাবে বললাম – ” হ! আপনি আমার পীর, আমি আপনার মুরিদ। রিস্ক আমার!! আপনি কেবল গল্প শুনিয়ে যান”
আমার কথা শুনে উনি খিলখিল করে হেসে উঠতেন। এভাবে করে শিবলী ভাইয়ের গল্প শুনে মাস্টার্স পর্যন্ত দিয়ে দিলাম। আমি যতটুকু মেধাবী, সেটুকুতে দিয়ে ইউজিসি নির্ধারিত ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক হবার মার্ক তুলে ফেলেছিলাম।
কোচিং সেন্টারে ইমনকে দেখে আফসোস হলো। ওর সাথে আগে কেন দেখা হলো না। এমন একটা দুটো ক্লাস পেলে এমনিতেই পড়ালেখা করতে ইচ্ছে হতো।
ইমন ক্লাসে সবার সামনে হঠাৎ বলে উঠলো, “এ্যাই মেয়ে! এমন অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন?”
আমি ভীষণ চমকে গেছি। অতীত স্মৃতিচারণ পর্ব থেকে বর্তমানে আগমন। কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। কারণ কেমন একটা ভ্রমের মধ্যে যেন ছিলাম। কিন্তু ইমন সহ পুরো ক্লাস এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো অগত্যা মুখ খুলতেই হলো।
আমি খুব শান্ত কন্ঠে বলেছিলাম, “আপনার পান্ডিত্য দেখে”।
ইমন আমার কথায় বেশ লজ্জা পেয়েছিলো। জিজ্ঞেস করলো, “কোন ইউনিভার্সিটি, কোন ডিপার্টমেন্ট?”
আমি- সিইউ, ইংলিশ
ইমন- (একটু অবাক হয়ে) মানে! আমার ডিপার্টমেন্ট জুনিয়র?
আমি- তাই তো মনে হচ্ছে।
ইমন- আমি তোমাকে কখনো দেখিনি।
আমি- আমিও আপনাকে কখনো দেখিনি।
আমার চটচট উত্তরে ক্লাসের সবাই মজা নিচ্ছিলো মনে হলো। শেষ উত্তরে সবাই সশব্দে হেসে উঠলো। ইমনের ভালো লাগলো এ আলাপচারিতা। ওর চোখ, মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিলো।
ক্লাস শেষে আমি যেন দেখা করি ওর সাথে, এ বলে আবার ক্লাসে মনোযোগ দিলো।
আমি ফুড কর্ণারের গ্লাস ওয়ালে তখনো মাথা ঠেকিয়ে পুরোনো কাহিনী ভাবছি।
ইমন কত দুর্ব্যবহার করতো, অসম্মান করতো আমাকে, কেন করতো! আমি তো কেবল সংসার করতে চেয়েছিলাম ওর সাথে।
ইমনের কন্ঠস্বর! কি বললো বুঝলাম না। ও আমার সামনে এসে বসলো।
বাহ! একেবারে শাড়িটাড়ি পরে বউ সেজে আসছো!
আমি- তুরস্ক থেকে এসে কাপড় ধোয়ার সুযোগ পাইনি। সব কাপড় অধোয়া। তাই শাড়ি পরে আসছি।
ইমন- ভালো হয়েছে। ভাগ্যিস কাপড় অধোয়া ছিলো? কিছু খাবে?
আমি -না
তুরস্কে থেকে কিছু গিফট নিয়ে আসছি ইমনের জন্য। ওর ভিসা পেতে সহযোগিতা করেছিলো। একটা টি-শার্ট যাতে লেখা আছে- Answer, not Questions. লেখা দেখেই ইমনের জন্য এনেছি এটা। এরপর টি-ব্যাগ বক্স, একটা লাইটার। প্যাকেটটা এগিয়ে দিলাম।
ইমন- কি দরকার ছিলো এসবের?
আমি – দরকার ছিলো।
ইমন বলতে শুরু করলো- দেখো সিরিয়াস কথা। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। কিছুদিন বিয়েটা গোপন রাখতে হবে। আর তুমি যাকে ভালোবাসো তার সাথে কোন শরীরিক সম্পর্কে যেতে পারবে না।
আমি এমনিতেই জেদি। ওর কথার জবাবে- আমি আমার মানুষটার সাথে সম্পর্ক অবশ্যই রাখবো। শারীরিক না হলেও, মানসিক সম্পর্ক থাকবে। আমি বিয়ে গোপন রাখতে যাবো কেন? আর দেনমোহর চল্লিশ লাখ না হলে আমি রাজি না।
ইমন- এ কেমন কথা! এটা আমার পক্ষে সম্ভব না আগেও বলেছি।
আমি- আমিও তো বহুবার বলে আসছি তোমাকে। আমি রাজি না। তোমার প্রতি কোন ভালোবাসা নেই আমার।
ইমন- ঠিক আছে। আর কখনো যোগাযোগ করবা না, আমিও করবো না। ব্লক করে দিচ্ছি তোমাকে। আর এসব গিফট নিয়ে যাও। তোমার কিছুই আমি রাখবো না।
আমি- আমার দরকার নাই তোমার সাথে যোগাযোগ করার।
ইমনের চোখ মুখে কালো মেঘ। বুকটার ভেতর হাহাকার হচ্ছে মনে হলো। তবু্ও পুরুষ মানুষ! শক্ত চোয়াল করে আছে।
আমি ওয়াশরুমে যেতে চাইলাম। কথা বলে লাভ নেই আর। ফ্রেশ হয়ে, শাড়ি গুছিয়ে বের হয়ে পড়ি।
সময় নিয়ে শাড়ি গোছালাম।
ইমন তখনো বসেছিলো। অথচ আমি আশা করেছিলাম ও চলে যাবে। আমি হনহন করে টেবিলের পাশে গিয়ে গিফটের প্যাকেটটা তুললাম। ইমন গ্লাস ওয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আমি টেবিলের পাশে আসাতে আমার দিকে আস্তে করে ফিরে তাকালো।
ওর চোখ মুখ আরও ভার, আরও অন্ধকার দেখাচ্ছে। বুক ভর্তি চাপা কান্না। চোখ ছল ছল। আমার বুকের ভেতরটা কেমন জানি হু হু করে উঠলো। এভাবে ওকে ছেড়ে যেতে আমার পা গুলো আর আগালো না। কেমন একটা মায়া আমাকে সজোরে টানছে। ধপ করে ওর পাশেই বসে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম – মন খারাপ কেন?
ইমন কিছুই বললো না কেবল আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
আমার তখন আকাশ ভেঙে কান্না পাচ্ছে। চোখের পানির ধারা কোনভাবেই আটকাতে পারছিলাম না।
ইমন হাত বাড়িয়ে বললো- তোকে অনেক ভালোবেসে ফেলছি। আমাকে ছেড়ে যাস না।
আমি বলেই যাচ্ছি- তোকে তো আমি ভালোবাসি না। কিন্তু এমন করে কেন কান্না করছি তা তো বুঝতে পারছি না।
ইমন আমাকে ওর বুকে টেনে নিলো আর আমি কান্না করেই যাচ্ছি। ও বলছে- আমাকে ভালো না বাসার তোর একশ একটা যুক্তি একদিকে। আর তোর এ অঝোরে কান্না একদিকে। আর বলতে হবে না কোনটা বেশি ভারী।