ভারতীয়দের সমুদ্রযাত্রাঃ ঐতিহ্য, বাস্তবতা ও ধর্ম (পর্ব-৫)

Khiladiyon ka khel aur kismat ka khel

উনিশ শতকের প্রথমভাগ থেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক কূপমণ্ডূকতা থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন অনেক হিন্দু তরুণ। কিন্তু পেরেছিলেন কেবল সামর্থবান, প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পন্ন মুক্তমনা কিছু পুরুষ যারা সকল ধর্মীয় ও সামাজিক নিষেধাজ্ঞা, অবজ্ঞা এবং জাতচ্যুতির ভয়কে তুচ্ছজ্ঞান করে

স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে পেরেছিলেন।

তাদের একজন রামমোহন রায়। মুক্তমনা ধার্মিক একজন স্কলার। সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছে ১৮১৫/১৬ তেই পোষণ করেছিলেন। কিন্তু সুযোগ এসেছিলো অনেক পরে।

রক্ষণশীল হিন্দু সমাজকে তিনি নানাভাবে সমালোচনা করতেন। প্রচন্ড পৌত্তলিকতা বিরোধী এবং প্রগতিশীল রামমোহনের সমুদ্রপাড়ি দেওয়া একটা জেদই বলা যায়। পরিশেষে সে সুযোগও এসে যায়।

মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবরের সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে যে চুক্তি হয়েছিলো যে অনুযায়ী ভাতা পাচ্ছিলেন না। তাই সম্রাট ১৮৩০ সালে রামমোহন রায়কে ‘রাজা’ উপাধি দিয়ে বিলেত পাঠান। তাঁদের মাঝে কথা হয়েছিলো, যদি তদবির করে ভাতা বাড়াতে পারেন তবে ভাতার একটা অংশ নিয়মিত ভাবে রাজা রামমোহন পাবেন।

রাজা রামমোহন রায় সম্রাটের দূত হিসেবে বিলেতে যান এবং অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সম্রাটের ভাতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। মূলত সম্রাটের সাথে কোম্পানির যে চুক্তি হয় তার উপর একটা বই লিখেছিলেন আগেই। সেই বইয়ের নাম ভাঙিয়ে কোম্পানিকে ব্ল্যাকমেইলিং করে সম্রাটের ভাতা বাড়িয়েছিলেন তিনি।

রামমোহনের লন্ডনে আসার আরো একটি কারণ ছিলো। সতীদাহ প্রথা আইনটি পুনরায় চালু করার জন্য ভারতবর্ষের সম্ভ্রান্ত হিন্দু ব্যক্তিবর্গ ও ব্রাহ্মণ পন্ডিতরা তদবির করছিলো। তাদের প্রচেষ্টা সফল না হতে দেওয়া রামমোহনের জন্য একরকম চ্যালেঞ্জ ছিলো। তাঁর সফল কূটনৈতিক তৎপরতায় সতীদাহপ্রথার অধ্যায় চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।

রামমোহনের সাথে বহু বছর ধরেই সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও দার্শনিকদের। একেশ্বরবাদী হওয়ার সুবাদে ইউনিটারিয়ান খ্রিস্টানদের বন্ধু মহলে তিনি বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ১৮২৮ সালের ২০ আগস্ট হিন্দু ধর্ম সংস্কারক রামমোহন একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম সমাজ ও ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা রহিত আইন বাস্তবায়নে যথেষ্ট অবদান থাকায় প্রশংসিত হন ইউরোপের সর্বত্রই। ম্যানচেস্টারে তাঁকে সংবর্ধনা জানাতে এত লোক এসেছিলো যে শেষ পর্যন্ত পুলিশের সহায়তা নেওয়া হয়েছিলো ভীড় সামলাতে।

উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত হওয়ার ফলপ্রসূতে ১৮১২ সালে স্পেনের খসড়া সংবিধান তাঁর নামে উৎসর্গ করেছিলেন সে দেশের উদারপন্থীরা।

লন্ডনে যাওয়ার সময় রামমোহনের সঙ্গী ছিলো মুসলিম বাবুর্চি,সন্তান রাজারাম, ব্রাহ্মণ তরুণ রামরতন মুখার্জি ও ভৃত্য রামহরি দাসকে।

জাত রক্ষা হবে কি হবে না এ ভাবনা অহেতুক ভেবে সময় নষ্ট কর‍তে চাননি। মুসলিম বাবুর্চির হাতের সুস্বাদু রান্না থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে চাননি অত্যন্ত বাস্তববাদী রসিক এবং সেই সাথে ভোজন রসিক প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরও।

আরেকটা তথ্য, রাজারামকে নিজ সন্তান হিসেবে পরিচয় দিলেও তিনি হলে রামমোহনের মুসলিম স্ত্রী বা রক্ষিতার সন্তান। তবে রামমোহনের ঔরসজাত কিনা তা সঠিক জানা যায় নি।

২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৩৩ সালে ম্যানেনজাইটিস রোগে ব্রিস্টলে মারা গেলে রক্ষণশীল হিন্দুদের অভিশাপ জয়যুক্ত হয়। কিন্তু বিপদে পড়ে যান রাজারাম ও রামরতন ও রামহরি। তবে তাদের ভারতবর্ষে আগমন করা থেকে শুরু করে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া থেকে রক্ষা করেছিলো তাদের প্রতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আনুকূল্য।

~~~~~~~~~~~~~~~~

Reference
বই : কালাপানির হাতছানি
লেখক: গোলাম মুর্শিদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *